ইকামাতে দ্বীনঃ শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সম্পর্ক

 

ইকামাতে দ্বীনঃ শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সম্পর্ক

লেখকঃ ইমাম হোসেন

প্রকাশকঃ যুব প্রত্যাশা প্রকাশনী

প্রকাশকালঃ প্রথম প্রকাশ, নভেম্বর, ২০২২

পুস্তক পর্যালোচনা

ইকামাতে দ্বীনের যে মহান মিশন নিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে তা আমাদের সবার জানা। ভারতীয় উপমহাদেশেও এই আন্দোলনের যাত্রা বহুবছর ধরে চলছে। ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলনের অন্যতম একটি সাফল্যের দিক হলো ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করে সাহিত্য রচনা। বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের কাছে ইকামাতে দ্বীন শব্দদয় নতুন কোনো পরিভাষা নয়, অনেক আগেই এর সাথে আমরা পরিচিত হয়েছি। বাংলাদেশে এই ধারার মৌলিক সাহিত্য অনেক হলেও এপার বাংলা অর্থাৎ আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অবদান কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়েরও নয়। যদিও আমাদের বঙ্গে কিছু কাজ তো অবশ্যই হয়েছে, অনুবাদ হলেও।

খুব সম্ভবত খোদ পশ্চিম্ববঙ্গের ভূমিপুত্রের কলম থেকে এই প্রথম আমরা এই টাইটেলের সাথে একটি রচনা পেলাম। কথা বলছি প্রখ্যাত অনুবাদক ও লেখক ইমাম হোসেনের “ইকামাতে দ্বীনঃ শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সম্পর্ক” বইটি সম্পর্কে। গত বছর প্রকাশিত এই বইটি নিয়ে দু-চারটি কথা।

লেখকের দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনের পদচারণায় আমরা ইতিমধ্যেই “সংগঠন ও সাংগঠনিক জীবন” ও “ইসলামী আন্দোলনঃ আত্মপর্যালোচনা ও পুনর্মূল্যায়ন” নামে দুইটি বই পেয়েছি। বলতে গেলে আলোচনার এই বইটি সেই লাইনের-ই সমৃদ্ধ ভার্সন।

 

বইটি সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত

প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে ইকামাতে দ্বীন পরিভাষা দিয়ে। লেখক সবিস্তারে এর অর্থ, ব্যপকতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমের ইকামাতে দ্বীন বই থেকে সরাসরি সাহায্য নিয়েছেন। ইকামাতে দ্বীন কি? ইকামাতে দ্বীন কি কোনও নতুন ধারণা? যুগে যুগে ইমাকাতে দ্বীনের ধারা কেমন ছিল? এই আধুনিক সময়ে আমাদের কাজের পরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিৎ এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবে এই অধ্যায়। এর পাশাপাশি যে বিষয়টি এই অধ্যায়টিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে তা হল সমসাময়িক ভারতীয় প্রেক্ষাপটের কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে ইকামাতে দ্বীনের ধারণাকে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা। যেমন ইউনিফর্ম সিভিল কোড এবং আগামি দিনের ন্যারেটিভ কেমন হওয়া উচিৎ।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক সবিস্তারে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। গতানুগতিক ধারার তাত্ত্বিক আলোচনার বেড়াকে অতিক্রম করে আমাদের মনে বারবার যে প্রশ্নগুলো উঁকি মারে ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলন করতে গিয়ে, সেগুলো কোনো রিজার্ভেশন ছাড়াই আলোচনায় নিয়ে আসা নিঃসন্দেহে লেখকের প্র‍্যাগম্যাটিক এবং সাহসী দৃষ্টিভঙ্গির-ই পরিচয় বহন করে। জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, রিযিকের ধারণা, সফলতার ধারণা সহ এমন অনেক প্রয়োজনীয় ধারণা যা এই পথে চলা কর্মীদের সুস্পষ্ট ভাবে জানা প্রয়োজন তা এখানে আলোচনা করা হয়েছে। বাদ যায়নি আত্মশুদ্ধির জন্য মৌলিক ইবাদাতের সাথে সম্পৃক্তার আলোচনা। 

তৃতীয় অধ্যায়ে দ্বিতীয় অধায়্যেরই এক্সটেনশন করে এর গুরুত্ব ও উপযোগীতা নিয়ে সুন্দর এবং সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা হয়েছে। 

কোনো কিছুই বাইরে থেকে ঠেকা দিয়ে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না। যদি দেহের ভিতর প্রাণ না থাকে তাহলে সেই দেহের যেমন কোনো মূল্য থাকে না, তেমনই এই আন্দোলনের পথে যদি কর্মীর আচরণ স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিক না হয়, তাহলে এই পথে বেশিদূর পাড়ি দেওয়া যায় না। চতুর্থ অধ্যায় এ নিয়ে আমাদের সাথে আলাপ করে। লেখক বলেন, “প্রথা সর্বস্ব, চাপিয়ে দেওয়া, বাধ্য করে শৃঙ্খলার চাষাবাদ করা হলে এর ফলন বেশি হবে না। ইসলামী মূল্যবোধ, নৈতিক সত্তা, নেতৃত্বের আনুগত্য, নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কর্মীর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিক মনোভাব থাকা খুবই জরুরি।” (পৃ. ৭৩) আন্দোলনী জীবনে একজন কর্মীর স্বতঃস্ফূর্তভাবে শৃঙ্খলাপরায়ণ হওয়া কত জরুরি তা এই অধ্যায়ে পরিস্কার করে উপস্থাপন করা হয়েছে। শৃঙ্খলার সীমাও যেন আমরা ভুলে না যায় তার প্রতিও সুক্ষ্ম ইঙ্গিত করতে ভুলে যাননি তিনি। শৃঙ্খলার দোহায় দিয়ে যেন কর্মীরা যেন উপলব্ধির ব্যপকতাকে সংকুচিত না করে সে বিষিয়েও লেখক দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখেন, “অনেক সময় দেখা যায়, উপলব্ধিগত সীমাবদ্ধতারর কারণেই কিছু কর্মী নিজেদের সাংগঠনিক বলয়ে বা ঘেরাটোপে বন্দি মনে করেন।” (পৃ. ৭৭)। ষষ্ঠ অধ্যায়ে উপরে উল্লেখিত শৃঙ্খলা কেন্দ্রিক তিনটি অধ্যায়ের নেতিবাচক দিক (অর্থাৎ সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ) গুলি নিয়ে আলচনা করা হয়েছে খুব হৃদয়গ্রাহী ভাষায়। 

মধ্যের পঞ্চম অধ্যায় একটি মৌলিক বিষয় নিয়ে হাজির হয়েছে, আর সেটি হল- “সংগঠন যেন জীবনের লক্ষ্যে পরিণত না হয়”। আমরা আমাদের জীবন উজার করে পৃথিবীকে সুন্দর করে সাজানোর জন্যে এই আন্দোলনের পথে চলার শপথ করেছি তা ঠিক, কিন্তু এই আন্দোলনের জন্য যে সংগঠন আমরা করি সেটাই যেন জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হয়ে না দাঁড়ায়। লেখক লেখেন, “ইকামাতে দ্বীন অর্থাৎ দ্বীন কায়েম করা বা রাখার জন্য জামায়াতবদ্ধ বা সাংগঠনিক জীবনের অপরিহার্যতা ও আবশ্যিকতা আমরা কুরআন ও সুন্নাহতে দেখতে পাই।…সংঘবদ্ধ জীবনের সামষ্টিক লক্ষ্য হল ইকামাতে দ্বীনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য হচ্ছে আখিরাতে নাজাত, মহান আল্লাহর রব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জন করা।…..আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জীবন হবে ইসলামমুখী- সংগঠনমুখী নয়, আমাদের পদচারণা হবে ইসলামকে ফোকাস করে- সংগঠনকে ফোকাস করে নয়।” (পৃ. ৮৩)

সপ্তম অর্থাৎ শেষ অধ্যায়ে লেখক সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সম্পর্কের মজবুতিকরণের কতক পথ ও পন্থা নতুনত্বের সাথে অবতারণা করেছেন। একের পর এক পয়েন্ট আকারে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। এখানেও এক নতুনত্বের ছোঁয়া দেখা যায়। কুরআনের ওহীর ক্রমকে নিয়ে এসেছেন এর জন্য যা খুবই কাকতালীয় ভাবে আমার ভাবনার সাথে মিলে যায়। কুরআনের আয়নায় পুরো অধ্যায়টিকে উপস্থাপনার এক সফল প্রয়াস এই অধ্যায়টি।

এই টপিকের উপর বই সাধারণত তত্ত্বের কোলাকুলিতে পরিপূর্ণ থাকে। কিন্তু শুরু থেকেই যে ব্যতিক্রম ধারার সাথে তরুণ লেখক অবতরণ করেছিলেন লেখালেখির জগতে, সেই ধারাকে এখানেও একই স্পিরিটে ধরে তাত্ত্বিকতার বাইরে গিয়ে একদম ব্যবহারিক চিত্রে ইকামাতে দ্বীনের ধারণা এবং প্রয়োগকে উপস্থাপনা করে লেখক সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।

বইটিকে আরও সুন্দর করে উপস্থাপন করা যেতে পারতো। ভাষাগত উৎকর্ষতা আর বিরামচিহ্ন গুলির ব্যবহারে আর একটু সিরিয়াসনেস বইটিকে আরও সুন্দর করতে পারতো। পাশাপাশি প্রুফ রিডিং বাড়াতে পারতো আর একটু খানি সবুজ সজীবতা। 

বইটি কাদের জন্য? এর উত্তরে সম্মানিত লেখক শুরুতেই তা স্পষ্ট করে দিয়ে লিখেন, যারা ইসলামী আন্দোলন, সংগঠনের সাথে যুক্ত, যারা ইসলামী রেনেসাঁর স্বপ্ন দেখে, যারা ইকামাতে দ্বীনের কাজে রত, যারা ইসলামের বুনিয়াদের উপর ভর করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও সভ্যতা গড়ার জন্য জামায়াতবদ্ধ জীবন পরিচালনা করছেন- তাদের উদ্দেশ্যেই এই বইটি রচিত।

_______________

✍️ Md Mursalim

Spread the love

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *