🖋️ মাওলানা মাহবুবুর রহমান
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, শিলচর।
এই ঈদ আমাদের শেখায়—ত্যাগই শ্রেষ্ঠ গুণ। আল্লাহর পথে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রিয় সন্তানের ক্বোরবানির প্রস্তুতি ছিল ঈমানের এমন এক অনন্য পরাকাষ্ঠা, যা ইতিহাসে যুগযুগ ধরে মানবতার মাপকাঠি হয়ে আছে। হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর মুখে উচ্চারিত সে শব্দ—“হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন”—সে এক চিরন্তন আত্মবোধের দৃষ্টান্ত।
ঈদ—এই শব্দটি কেবল খুশির প্রতীক নয়, বরং এক অপূর্ব আত্মার আহ্বান। আর ঈদুল আযহা? এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়—বরং এক মহাকাব্যিক আত্মোত্সর্গের নাম, যেখানে হৃদয়বৃত্তি জয় করে বাহ্যিকতাকে, যেখানে মানুষ নিজেকে জয় করে মানুষের জন্য।
আসলে ক্বোরবানি মানেই তো এক আভ্যন্তরীণ বিপ্লব—নিজের ভেতরের পশুত্বকে নিঃশব্দে জবাই করার সাহস।
আল্লাহ বলেন:
“তাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না; বরং পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া।” (সূরা হজ্জ: ৩৭)
এই আয়াত যেন আমাদের আত্মার দরজায় কড়া নাড়ে—বলতে চায়, ‘ও মনুষ্য, বাহ্যিকতার আবরণ ছিঁড়ে ভেতরের সত্যকে চিনো।’
ক্বোরবানির সমাজতাত্ত্বিক সৌন্দর্য অপরূপ।ক্বোরবানি কেবল ইবাদত নয়—এ এক সুবিন্যস্ত সামাজিক বণ্টন ব্যবস্থা, যা মানবিক সাম্যতায় অনন্য। তিন ভাগে ভাগ করা মাংস—নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য, ও গরীবের জন্য—এটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং শ্রেণি-বৈষম্যবিহীন মানবিক সমাজ গঠনের এক প্রতীকী রূপরেখা।
ঈদের হাসি যদি দরিদ্রের মুখে না ফোটে, তবে সে ঈদের সার্থকতা কোথায়? গবেষণায় প্রমাণিত, কুরবানির সময় বহু দরিদ্র পরিবার বছরে একবার হলেও প্রাণবন্ত পুষ্টি লাভ করে। এই উৎসব তাই একান্তভাবে একটি মানবিক আর্থ-সামাজিক নবজাগরণ।
এদিকে ঈদুল আযহা শুধুই ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞও বটে। পশু খামার, পরিবহন, খোলা হাট, চামড়া শিল্প, জবাইখানা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা—সবমিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার দিশা হয়ে দাঁড়ায় এই উৎসব। এটি গ্রাম ও শহরের মাঝে তৈরি করে এক সেতুবন্ধন—একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক গতিশীলতা।
দুঃখজনকভাবে আজ কোথাও কোথাও এই মহৎ উৎসবের হৃদয়হীন রূপও দেখা যায়—যেখানে ক্বোরবানি হয়ে ওঠে প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা, পশুর প্রতি নির্দয় আচরণ, পরিবেশ দূষণ, ও অর্থ-সম্পদের অহঙ্কার প্রকাশের মঞ্চ। এ যেন ত্যাগের নামে আত্মবিস্মরণের কাহিনি।
এই অবক্ষয় রোধে চাই আত্মজাগরণ—আবশ্যক সত্য উপলব্ধি ও সমবেদনার হৃদয়চর্চা। নচেত ঈদ হয়ে উঠবে এক নিঃসার বাহ্যিক আয়োজনে।
ঈদ আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থান ও মানবিক সম্প্রসারণের এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম। একটি সমাজের সৌন্দর্য তখনই চূড়ান্তে পৌঁছায়, যখন তার প্রতিটি সদস্য অপরের যন্ত্রণাকে অনুভব করতে শেখে। ঈদুল আযহা সেই উপলক্ষ—যেখানে মুসলমান ক্বোরবানি(আত্মত্যাগ) করে, তবে আনন্দটা যেন ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশী হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সকলের মুখে। এখানে ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে চলে মানবিক মর্যাদার এক অপূর্ব সহাবস্থান।
ক্বোরবানি মানে কেবল পশু জবাই নয়। এটি আত্মার পশুস্বভাব—অহংকার, হিংসা, হিংস্রতা, লোভ, হীনমন্যতা—এই সব কিছুকে নিঃশেষ করা। ঈদের নামায শেষে ক্বোরবানি ছুরি কেবল পশুর গলায় নয়, বরং নিজস্ব আত্মমোহের গলায় চালানো—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
এই ঈদে হোক আত্মবিপ্লব।
আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞা কর—
-আমরা জবাই করব হৃদয়ের পশুত্বকে,
-আমরা বণ্টন করব ভালবাসা ও সহানুভূতির আলো,
-আমরা গড়ে তুলব এক শ্রদ্ধাশীল, সহমর্মী, শান্তিপূর্ণ সমাজ।
ক্বোরবানি কেবল ছুরি চালানোর কাজ নয়, এটি হৃদয়ে নরম আলো জ্বালানোর এক নাম। আমাদের প্রার্থনা —এই উৎসব হোক আত্মশুদ্ধির দীপ্ত অধ্যায়, হোক অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর এক অপার আনন্দ। ঈদ যেন সীমিত না থাকে একদিনের আনুষ্ঠানিকতায়, বরং তা হয়ে উঠুক জীবনের প্রতিটি দিনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার এক অন্তর্নিহিত প্রেরণা। তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম। ঈদুকুম মোবারক।
🌺🌺🌺