নিরহ মানুষের মৃত্যু: এক নিঃসীম বেদনার গল্প

নিরহ মানুষের মৃত্যু: এক নিঃসীম বেদনার গল্প

কিছু ব্যথা আছে যেগুলো শব্দে প্রকাশ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায় অন্তরের গভীরে। কিছু মৃত্যু আছে, যেগুলো শুধু একটা জীবনের অবসান নয়—একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ, একটি সমাজের বিবেকের পতন, আর একটি জাতির আত্মার আর্তনাদ। নিরহ মানুষের মৃত্যু তেমনই এক বেদনার অধ্যায়, এক অসহায়তা ও কষ্টের প্রতিচ্ছবি, যেটি চোখের জলে নয়, হৃদয়ের রক্তক্ষরণে লেখা হয় যা হৃদয়ের গহীনে চেপে বসে থাকে দীর্ঘকাল। যে মানুষটি জীবনে কারো ক্ষতি করেনি, যার চোখে ছিল স্বপ্ন, হৃদয়ে ছিল শান্তি আর আচরণে ছিল বিনয়, যাদের কোনো দোষ ছিল না, যারা শুধুই শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করছিল, যে সামান্য প্রশান্তির খোঁজে বেরিয়েছিল ঘরের বাইরে, অকারণে, অন্যায়ভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া যেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যকে মুহূর্তে ম্লান করে দেয়। তার নিঃসঙ্গ বিদায় যেন এক নীরব বিস্ফোরণ। মৃত্যু তো চিরন্তন সত্য, কিন্তু যখন তা অন্যায়ভাবে, অকারণে একজন নিরপরাধ মানুষের জীবনে ঘটে যায়, তখন সেই মৃত্যুকে মেনে নেওয়া হয়ে যায় হৃদয়বিদারক।


এই মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা কী ভয়ানক এক অসহায় সমাজে বাস করি, যেখানে ভালো থাকা, ন্যায়ের পথে চলা, কারো ক্ষতি না করে জীবনযাপন করাও কখনো কখনো অপরাধে পরিণত হয়। কীভাবে আমরা এমন সমাজে বাস করছি, যেখানে একটা ভালো মানুষের জীবন এইভাবে নিভে যেতে পারে—এই প্রশ্ন আমাদের ঘুম কেড়ে নেয়। প্রতিবাদ না করতে পারার গ্লানি, কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা, আর প্রতিবারই একই অপারগতা—সব মিলিয়ে এক অসহনীয় যন্ত্রণার ভার বইতে হয় আমাদের।
এই ধরনের মৃত্যু যেন কেবল একটি জীবনকে থামিয়ে দেয় না, বরং ভেঙে দেয় বহু মানুষের ভরসা, ভালোবাসা ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। নিয়ে যায় তার সন্তানের ভবিষ্যৎ, তার মায়ের হাসি, আর তার বন্ধুবান্ধবের জীবনের রঙ। রেখে যায় শুধুই কিছু চোখের জল, কিছু দুঃস্বপ্ন, আর এক অনন্ত শূন্যতা। পেছনে রয়ে যায় আহাজারি, শূন্যতা আর কিছু অপ্রকাশ্য প্রশ্ন—”কেন?” “কেন এমন হলো?” প্রশ্নগুলো ঝড়ের মতো ঘুরে ফিরে আসে, কিন্তু উত্তর হয় না কিছুই। চারপাশে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও, সেই নিরহ প্রাণ হারানোর ঘটনা এক চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে সমাজের বুকে রয়ে যায়। তার পরিবার হারিয়ে ফেলে জীবনের আলো, মা হারায় বুকের ধন, সন্তান হারায় অভিভাবক, জীবন হারায় স্বাভাবিকতা।
এই মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা কতোটা অসহায়, কতোটা অরক্ষিত। এটি আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়, সমাজের অবিচার আর নিপীড়নের মুখোশ খুলে দেয়। একটি নিরপরাধ প্রাণের অবসান কখনো শুধুই একটি দুঃসংবাদ নয়, এটি একটি সমাজের ব্যর্থতা, ব্যর্থতা আরো অনেকের, একটি সভ্যতার অপমান। আমরা যখন চোখ বন্ধ করে থাকি, অন্যায় দেখে চুপ থাকি—তখনই জন্ম নেয় এমন মৃত্যু।
এই মৃত্যু আমাদের কাঁদায়, কিন্তু সেই কান্নার শব্দ থাকে নিঃশব্দ। আমরা তাকিয়ে থাকি, কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায় দগ্ধ হই, আর প্রতিবারই অনুভব করি—আমরা যেন আরেকটু ভালো হলে, আরেকটু সচেতন হলে, হয়তো এই মৃত্যু এড়ানো যেত। কিন্তু হায়, সময় আর ফিরে আসে না। থেকে যায় শুধুই স্মৃতি, কান্না আর এক অপার বেদনার গল্প।
এই মৃত্যু যেন আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—প্রতিটি নীরবতা, প্রতিটি চুপ করে থাকা, আর প্রতিটি ভয়—একটি নিরহ প্রাণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। আর আমরা, কেবল অসহায় দর্শক হয়ে, সেই মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে থাকি।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *